আজকের যুগে আধুনিক শিক্ষিত অনেক মুসলিমকেই দেখা যায় পাশ্চাত্যের নিয়মনীতির প্রতি কিছুটা নরম মনোভাব প্রকাশ করতে। পাশ্চাত্যের নিয়মনীতি বলতে তারা সেক্যুলারিজমের অনেক কিছুকেই গ্রহন করতে প্রস্তুত। আবার অনেকেই আছে যারা পাশ্চাত্যের প্রতি পুুরোপুরি আত্মসমর্পণকরী। আর তারা এটাকে ইসলাম ও মুসলিমদের জন্য অনেক কল্যাণকর ভাবে। এর বিপরীতে যখন তাদেরকে ইসলামি শরিয়ার কথা বলা হয় তখন তারা একরকম অস্বস্তিতে পরে যায়। কেউ বা আবার বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে শরিয়া আইনের প্রতি নাক সিটকায়, ভাবে মধ্যযুগীয় আইন এযুগে কিভাবে চলবে! এদের অনেক বিশেষজ্ঞ বা অনুসারীই প্রচার করে প্রাথমিক যুগ থেকেই ইসলামি বিশ্ব নাকি সেক্যুলার ছিল। আমাদের দৃষ্টিতে এটা ডাহা মিথ্যাচার বলেই মনে হয়।
বলা যায় যে, তারা পাশ্চাত্যের জাঁকজমকতা দেখে নিজের অজান্তেই এক রকম ভয় পায়, নিজের থেকেই কান ধরার নীতিতে তারা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। আর এটার কারণ মূলত ইসলাম ও সেক্যুলারিজম সম্পর্কে মৌলিক জ্ঞানের অভাব এবং উভয়ের মাঝে পার্থক্য করার অক্ষমতা।
“মুসলিম শব্দটি সালাম শব্দ থেকে উৎপত্তি যার শাব্দিক অর্থ শান্তি ও নিরাপত্তা বিধান করা। মুসলিম শব্দের অর্থ আত্নসর্মপনকারী।
পারিভাষিক অর্থেঃ
যে ব্যক্তি একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামিনকে মহান প্রতিপালক হিসেবে গ্রহন করবে, আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করবেনা এবং রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর নির্দেশিত পথে নিজের জীবন চালাবে, হালাল কে হালাল বলে মানবে এবং হারামকে বয়কট করবে, সালাত প্রতিষ্ঠা করবে, রোজা রাখবে, নিসাবের অধিকারী হলে যাকাত আদায় করবে এবং হজ্জে গমন করবে। এইসব গুনাবলীর অধিকারী হলে তাকে মুসলিম বলা হয়।”
আর_
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ (Secularism) বলতে বোঝায় পার্থিব,ইহজগতিক, ধর্মহীনতা। রাষ্ট্র আর ধর্মকে পৃথকরূপে প্রকাশ করা । কিছু নির্দিষ্ট প্রথা বা প্রতিষ্ঠানকে ধর্ম বা ধর্মীয় রীতিনীতির বাইরে থেকে পরিচালনা করাকে বোঝানো হয়।
Oxford Learner’s Dictionary এর মতে সেক্যুলারিজম বলতে বুঝায়
”the belief that religion should not be involved in the organization of society, education, etc.”
আর Cambridge Dictionary মতে
“the belief that religion should not be involved with the ordinary social and political activities of a country.”
এখন চিন্তা করুন যদি কেউ রাষ্ট্রের বা সমাজের নিয়মনীতি কে ধর্মের বাহিরে রাখে তাহলে তাকে ইসলামের কত গুলো বিধান কে অস্বীকার করতে হবে। যেখানে কুরানের ১টি হরফ কেউ অস্বীকার করলে ইমান থাকেনা, সেখানে কত গুলো আয়াত কে অস্বীকার করতেছে। সেক্যুরারিজমে বিশ্বাস মানে আপনি শুধু তাদের নিয়ম নীতি মেনেই নিচ্ছেন না বা ইসলাম কে রাষ্ট্র ব্যবস্হা থেকে আলাদাই করছেন না বরং পাশ্চাত্যের আইন কানুন কে আল্লাহর আইনের তুলনায় উৎকৃষ্টতর মনে করতেছেন (নাউজুবিল্লাহ)। সেক্যুলারিজমে বিশ্বাস বা এর প্রতি দুর্বলতা তাহলে কত মারাত্মক আশাকরি বুঝতে পেরেছেন।
ইসলামে প্রবেশ করার পর এমন কোন সুযোগ আছে কি, আপনি ব্যক্তি সম্পর্কিত বিধান গুলো মেনে নিবেন আর সমাজ, রাষ্ট্র, শিক্ষা ব্যবস্হা, বিচার ব্যবস্হা সম্পর্কিত বিধান গুলো অস্বীকার করবেন??? না, এরকম কোন সুযোগ ইসলাম আপনাকে দেয়না।
এখন দুর্বল ইমান থাকলে প্রশ্ন করতে পারেন, মধ্যযুগীয় বিধিবিধান কি এযুগে চলতে পারবে??? এর উত্তর নিশ্চিত ভাবে ‘হ্যাঁ’ ই হবে। কেননা ইসলামের বিধানের চাইতে আধুনিক বিধান আর কোনটাই হতে পারেনা, ইসলামের চাইতে উপকারী বিধান আর একটাও থাকতে পারেনা। স্রষ্টা যে আইন দিয়েছে, সৃষ্টি তার সমান বা উৎকৃষ্টতর আইন তৈরি করবে এটা অকল্পনীয়। স্বাভাবিক দৃষ্টিকোণেও চরম ধৃষ্টতার শামিল এ ধরনের চিন্তা বা বিশ্বাস।
একটু চিন্তা করুন, আর মধ্যযুগের ইসলামিক সমাজ ব্যবস্হার সাথে তুলনা করুন। এই সব কথিত আধুনিক বিধান দিয়ে কি হত্যার মত অপরাধ মধ্যযুগের মুসলিম সমাজের চেয়ে কমে গেছে? ধর্ষন কি সেসময়কার মুসলিম বিশ্বের চেয়ে কম হয়? চুরি, মদপান কি একটুও কম হয় সে সময়ের চেয়ে??? এর সব গুলোর উত্তর ‘না’ হবে। বরং আমেরিকানরা বছরের পর বছর প্রচারনা চালিয়ে, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করার পরেও তাদের কথিত আধুনিক আইন দিয়ে মদপান কমাতে পারেনি। কিন্তু মধ্যযুগে ইসলাম তার আইন দিয়ে খুব সহজেই মদপান সমাজ থেকে বিদায় করেছিল। আর হত্যা, ধর্ষন বা চুরি তো কল্পনাই করা যেতনা।
পাশ্চাত্যের যে আইনের প্রায়োগিক ফল ইসলামের আইনের তুলনায় কিছুই নয়, যে আইনের প্রতি বিশ্বাস ইসলামের বিরুদ্ধে যায়, সে ব্যবস্হার প্রতি এত দুর্বলতা কেন মুসলমান ভাই? পাশ্চাত্যের প্রতি আপনাদের এত উদারতার পরেও কি ফিলিস্তিন মুক্ত হবে ভাবছেন? আরাকান মুক্ত হবে ভাবছেন? উইঘুর নির্যাতন বন্ধ হবে মনে করছেন? মুসলিম বিশ্বে পাশ্চাত্যের থাবা বন্ধ হবে ভেবেছেন? আসলে কোন কিছুই বন্ধ হবে না। বরং পাশ্চাত্যের জমকালো সভ্যতা আপনাকে আরও অন্ধকারে নিয়ে যাবে। এভাবে কাটছাট করতে করতে ইসলামের কিছুই বাকি থাকবেনা। কারণ আপনি যদি তাদের মত না হন তাহলে তারা কখনোই খুশি হবেনা, এটা আল্লাহ তায়ালা কোরআনেই বলে দিয়েছেন।
وَ لَنۡ تَرۡضٰی عَنۡکَ الۡیَہُوۡدُ وَ لَا النَّصٰرٰی حَتّٰی تَتَّبِعَ مِلَّتَہُمۡ ؕ قُلۡ اِنَّ ہُدَی اللّٰہِ ہُوَ الۡہُدٰی ؕ وَ لَئِنِ اتَّبَعۡتَ اَہۡوَآءَہُمۡ بَعۡدَ الَّذِیۡ جَآءَکَ مِنَ الۡعِلۡمِ ۙ مَا لَکَ مِنَ اللّٰہِ مِنۡ وَّلِیٍّ وَّ لَا نَصِیۡرٍ۰
“অর্থ: আর ইয়াহূদী ও নাসারারা কখনো তোমার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না, যতক্ষণ না তুমি তাদের মিল্লাতের অনুসরণ কর। বল, ‘নিশ্চয় আল্লাহর হিদায়াতই (প্রকৃত) হিদায়াত’ আর তোমার কাছে জ্ঞান আসার পরেও যদি তুমি তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ কর, তাহলে আল্লাহর বিপরীতে তোমার কোন অভিভাবক ও সাহায্যকারী থাকবে না।”
(সূরা বাকারা-১২০)
কম্যুনিজম প্রতিষ্ঠার ইতিহাস কল্পনা করলেও এসব সভ্যতার স্থায়িত্ব অনুধাবন করতে পারবেন। পুঁজিবাদের জয়জয়কার যখন চলছে ঠিক তখনই কম্যুনিজমের আবির্ভাব। যখন কেউ ভাবতেও পারতো না পুঁজিবাদ কে কোন মতবাদ চ্যালেঞ্জ করবে। সেই সময়েই কার্ল মার্কস কম্যুনিজমের প্রচার শুরু করতে লাগলেন আর ত্রিশ- চল্লিশ বছরের মধ্যেই এ মতবাদ পুঁজিবাদ কে কাঁপিয়ে দিল। রীতিমত চ্যালেঞ্জ করে বসলো পাশ্চাত্যকে। সমানে সমান ভাবে পাশ্চাত্যের বিরোধীতা করতে লাগলো আর আশে পাশের দেশ গুলোকে তার পেটের ভিতর ঢুকাতে লাগলো।
সে সময় কম্যুনিজমের জয়জয়কারে কিছু মুসলিম তাদের প্রতিও দুর্বলতা দেখাতো। ইসলাম কে কম্যুনিজমের সাথে সাদৃশ্য করে ব্যাখ্যা করতো। তারা মনে করতো কম্যুনিজমই মানব জাতিকে প্রকৃত মুক্তি দিতে পারে, তাই সব কিছুকে কম্যুনিজমের দর্পনে দেখার চেষ্টা করতো। কিন্তু মাত্র কয়েক দশকের ব্যবধানে সব ভূত মাথা থেকে উড়ে গেল। কিছুদিন পরে কম্যুনিজমের মূল রাষ্ট্রের শিকড়টাই উপরে গেল। সে সময়ে যারা কম্যুনিজমের অভ্রান্ততার বিশ্বাস নিয়ে মারা গেছে বা তাদের মতবাদের প্রতি স্থায়িত্বতার বিশ্বাস নিয়ে মারা গেছে, এখন তাদের অবস্হা কল্পান করুন!
ঠিক যখন পাশ্চাত্যের সময়ও শেষ হয়ে আসবে তখন এ সভ্যতাও তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে পরবে। পূর্বের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখুন, আগেও এমন সভ্যতা পৃথিবীতে বিদ্যমান ছিল যাদের কে তৎকালীন মানুষেরা অপরাজেয় মনে করতো। তাদের প্রবল শক্তি-সামর্থের সামনে মাথানত করতো। আল্লাহ তায়ালা এসব পাপিষ্ঠ জাতিকে এত ক্ষমতা দান করেছিলেন যে এসব সভ্যতা কখনো ধ্বংস হতে পারে তারা কল্পনাও করতে পারতো না। কিন্তু সময় ফুরানোর সাথে সাথে কিভাবে আল্লাহ তায়ালা সেসব সভ্যতাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছেন। পাশ্চাত্য সভ্যতাও এর ব্যতিক্রম নয়।
Leave a Reply